www.ullas24.com

Breaking

21 April, 2020

বন্ধুত্বের প্রকৃতি


বন্ধুত্বের প্রকৃতি


আব্দুর রউফ সালাফী, মাস্টার্স (অধ্যয়নরত), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,



মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস হেতু আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি সহ বিভিন্ন সম্মন্ধীয় সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি। বন্ধুত্ব তেমনই এক সম্পর্ক। বন্ধুত্ব এমন এক সম্পর্ক যা দুটি মনকে যুগ যুগ ধরে মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ রাখে। বন্ধুত্ব কেমন হওয়া উচিত? আসুন ইসলাম এ সম্পর্কে কি বলে তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে জেনে নেওয়া যাক।

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। মানব জীবনের প্রতিটি শাখায় ইসলামি জীবন-যাপনের তাগিদ রয়েছে। ইসলামে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধকে অন্যান্য সকল ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে পরস্পর আপন হওয়া যায় তার বহু উদাহরণ হাদীছে মওযুদ রয়েছে। মহান আল্লাহ তা'আলা এ সম্পর্কে পবিত্র কুর'আনে বলেন, 'মু’মিন পুরুষ আর মু’মিন নারী পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, নামায ক্বায়িম করে, যাকাত দেয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। তাদের প্রতিই আল্লাহ করুণা প্রদর্শন করবেন।(সূরা তওবাহ : ৭১)' হাদীছে রাসূল(ছাঃ) বলেছেন, ' এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই,,,,,,,,,।(মুসলিম হা/২৫৬৪) উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে ইসলামে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। এ বন্ধনের ইঙ্গিত রক্তের বন্ধনের নয় এ বন্ধন বিশ্বজনীন বন্ধুত্বের বন্ধন। সুতরাং আমাদের জানা প্রয়োজন ইসলাম বন্ধুত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে কি বলে। কোন শ্রেণির মানুষের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা উচিত এবং কার সাথে বন্ধুত্ব করা অনুচিত সে বিষয়ে ইসলাম আলোকপাত করেছে।

আল্লাহ তা'আলা মানুষের অন্তরে যে দয়া-মায়া সৃস্টি করেছেন তার বদৌলতে আমরা বন্ধুত্ব নামক ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হই। কিন্তু সমাজের নিয়মে ভালো-মন্দের সাথে আমাদের টিকে থাকতে হয়। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আমাদের উভয় পরিস্থিতির সাথে পরিচয় ঘটে। যদি আমরা ভালো বন্ধু নির্বাচন করি তাহলে ইহকাল ও পরকালে কামিয়াবি অর্জন করতে পারব। আর যদি বন্ধু নির্বাচনে ভুল হয় তবে উভয় জীবনে ধ্বংস অনিবার্য। সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন, ' ওহে যারা আল্লাহকে ভয় করো তারা সত্যবাদীকে বন্ধু রুপে গ্রহণ করো। (সূরা তওবাহ :  ১১৯)' রাসূল(ছাঃ) বলেন, ' মানুষ তার বন্ধুর স্বভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়। সুতরাং সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে তা যেন দেখে নেয়।(তিরমিযী হা/ ২৩৭৮)' আমরা সবাই জানি সৎ সঙ্গে সর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। সৎ সঙ্গ ও অসৎ সঙ্গের প্রকৃষ্ট একটা উদাহরণ হাদীছে রয়েছে। বিশ্বনবী (ছাঃ) বলেন, 'ভালো বন্ধু ও খারাপ বন্ধুর উদাহরণ আতর বিক্রেতা ও কামারের মত। কেউ আতর বিক্রেতার কাছে গেল কিন্তু আতর না কিনলেও হয়ত বিক্রেতা তাকে কিছু দান করবে অথবা তার কাছ থেকে সুঘ্রাণ পাবে। অপরদিকে কেউ কামারের কাছে গেলে কামারের গায়ের দুর্গন্ধ পাবে আবার আগুনের ফুলকি তার পোশাকও পুড়িয়ে দিতে পারে।(মুসলিম হা/২৬২৮)


www.fb.com/ullas.org

একজন ভালো বন্ধু নিজে ন্যায় ও সৎ পথে চলতে চেস্টা করে এবং নিজ বন্ধুকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে সচেস্ট হয়। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ (পূর্ণ) মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।’(বুখারী হা/ ১৩) ভালো বন্ধু যে সমস্ত কাজ নিজের জন্য অন্যায়, অশ্লীল ও মন্দ বলে মনেকরে তা তার বন্ধুর জন্যও যদি মনে না করে তবে সে কখনো ভালো বন্ধু নয়। সে অবশ্যই মুনাফিক। সে জন্য ভালো বন্ধুর উদাহরণ আতর বিক্রেতার সাথে দেওয়া হয়েছে কারণ- কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব না করলেও কখনো তার দ্বারা অমঙ্গল হবে না। সেজন্য যে বন্ধু সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে সেরকম বন্ধু নির্বাচন করে তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা উচিত। তাহলে উভয়ের ইহকাল ও পরকাল মঙ্গলময় হবে। কেননা হাদীছে এসেছে আল্লাহ ছায়াহীন ক্বিয়ামতের কঠিন মূহুর্তে যে সাত শ্রেণির ব্যক্তিকে নিজ আরশের নিচে ছায়া দিবেন তাদের মধ্যে ঐ দুজন রয়েছে যারা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই বিচ্ছিন্ন হয় অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত বন্ধুত্ব বজায় রাখে।(বুখারী হা/ ৬৬০)

অপরদিকে, যে বন্ধু নিজ বন্ধুকে অন্যায় করতে দেখে চুপ থাকে বা উৎসাহ প্রদাণ করে, নিজে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে কিন্তু স্বীয় বন্ধুকে খারাপ পথে পরিচালিত করে, নিজের জন্য যা ভালো মনে করে সে সম্পর্কে  বন্ধুকে কিছুই জানায় না ; এ শ্রেণির বন্ধু সে কামারের মত যার কাছে বসলে দুর্গন্ধ ও আগুনের ফুলকি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। এরকম স্বার্থপর মুনাফিক বন্ধু দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। এ শ্রেণির বন্ধু নিজের স্বার্থ ছাড়া এক কদম পা বাড়ায় না। তাইতো ফারসি কবি শেখ সা'দি কবতায় লিখেছেন-
            'এই অসৎ বন্ধুদের দেখবে তুমি 
            মিষ্টির চতুর্পার্শ্বে যেমন উড়ে মাছি।'

সুধী পাঠক, বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে দিন যত বাড়ছে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তত অবহেলার চোখে দেখছে। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা অনেক বেশি। ফলে একদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বন্ধুত্বের নামে পরস্পর পরস্পরের অতি কাছে আসার ফলে প্রতারণার মাত্রা বেড়েছে। ফেইজবুক বা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে বন্ধুত্বের অনুভূতি কাজে লাগিয়ে ইসলামি বিধানকে তোয়াক্কা না করে নারী-পুরুষ পরস্পরে অবৈধ প্রেমে লিপ্ত হচ্ছে। এর প্রভাবে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপন, ধর্ষণ, কোর্ট ম্যারেজ,  অর্থ নিয়ে প্রতারণাসহ বহু সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে আমাদের সমাজ। অন্যদিকে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিগুলোতে আমরা যাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছি তাদের অধিকাংশ কথিত প্রেমাসক্ত, মাদকাসক্ত, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী অথবা রাজনীতির নামে কথিত চেতনাবাজ! যে বন্ধু যে অবস্থানে আছে সে তার বন্ধুকে সে পথের দিকেই ধাবিত করছে। ফলশ্রুতিতে কেউ মাদকে অভ্যস্ত হয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছে,  কেউ একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে চরিত্র ধ্বংস করছে, কেউবা আবার সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ হিসেবে গড়ে উঠছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রত্যেকে তাদের বন্ধুর কাছ থেকে প্রতারিত হচ্ছে অথচ তা ভেবে দেখছে না। ব্যর্থ প্রেমীককে তার উৎসাহ দাতা বন্ধু ডিপ্রেশনে ফেলে নিজে নির্ভাবনায় দিন যাপন করছে,  চাঁদাবাজ বন্ধু অপর চাঁদবাজ বন্ধুকে বড় দাউ মারার জন্য বিপদে ঠেলে দিচ্ছে, ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী বন্ধু অপর বন্ধুর প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব অন্তরে লুকিয়ে কৌশলে নিজ বন্ধুকে পড়াশোনার পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিজে ভাল ফলাফল অর্জন করছে। এভাবেই নিজেদের সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন-যৌবন ভুল পথে পরিচালিত করছে অথচ এগুলোকেই তারা প্রকৃত বন্ধুত্ব ভাবছে। অন্যায় কাজগুলো করতে করতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে, সেগুলোকে অন্যায় মানতেও নারাজ। তাই কেউ নিষেধ করলে আমাদের সাধারণ ডায়লগ হচ্ছে- এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবেন না, সব কিছুর মধ্যে ধর্ম ঢুকাবেন না ইত্যাদি!! অথচ শুরুতেই আমরা সূরা তওবার ৭১ নং আয়াত নিয়ে এসে দেখাতে চেয়েছি  যে, আল্লাহ এক বন্ধুকে অপর বন্ধুর জন্য অভিভাবক করেছেন। তাদের প্রথম কাজই হলো তারা পরস্পরকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে। কুর'আন ও হাদীছে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ সম্পর্কে বহু দলিল রয়েছে। কেউ কাউকে অন্যায় বা খারাপ কাজ করতে দেখলে প্রথমে হাত দ্বারা বাঁধা দিবে দিবে, তারপর কথা দ্বারা আর যদি সে ক্ষমতাও না থাকে তবে অন্তর দ্বারা সে কাজকে ঘৃণা করবে। (বুখারী হা/ ৯৫৬) কেউ তার বন্ধুকে ভাল কাজে উৎসাহিত করলে সে যদি তা করে তবে উভয়ই নেকী পাবে। মৃত্যুর পরেও যদি তার বন্ধু সে কাজ করতে থাকে তবে কবরেও নেকী পাবে। অনুরূপ অসৎ পথে পরিচালিত করলে বা পরামর্শ দিলে সে যদি তা করতে থাকে তবে মৃত্যুর পরেও তার পাপের ফল ভোগ করতে থাকবে। উভয়ের পাপ অথবা নেকীর কোন অংশ কম করা হবে না। (মুসলিম হা/ ২৬৭৪)

সুতরাং হে মুসলিম যুবসমাজ! বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতে হবে। বন্ধুত্বের ভালোবাসা অবশ্যই সৎ পথে পরিচালিত করতে হবে। দুই দেহ এক আত্মার মেলবন্ধনের নাম যদি বন্ধুত্ব হয় তবে সেখানে ব্যক্তিগত ব্যাপার নামক দেয়াল তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতে কখনো ভুল পথে পা বাড়ালে নিজের প্রাণের বন্ধুই 'সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার' বলে এড়িয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের সৎ বন্ধুত্বের ছায়ায় থেকে ইহকাল ও পরকালীন জীবন গঠনের তাওফিক্ব দান করুন। আমিন!

আব্দুর রউফ সালাফী, মাস্টার্স (অধ্যয়নরত), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,
মোবাঃ 01723688443
ইমেইলঃ salafi12016@gmail.com 

No comments:

Post a Comment

Pages