www.ullas24.com

Breaking

25 April, 2020

মহামারিতে রমাযান কীভাবে কাটাবেন

মহামারিতে রমাযান কীভাবে কাটাবেন
আব্দুর রউফ সালাফী,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


মহান আল্লাহ বলেনঃ 'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকেদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।'(সূরা বাকারা- ১৮৩)
পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানদের জন্য রমাযান এক বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ মাস। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুসলমানগণ মহান রবের ফরজ বিধান পালন করে থাকে। পাড়া-মহল্লা কিংবা গ্রামের ছোট-বড় মসজিদে মুসল্লিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ধনী-গরিব সকলের মনে স্বর্গীয় সুখ অনুভব হয় এবং আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এ প্রথম রমাযান মাস এসেছে যেখানে মুসলমানগণ করোনা নামক এক মরণঘাতী মহামারি ভাইরাসের কারণে মসজিদে যাওয়া তো দূরের কথা ঘর থেকে বের হতেই পারবে না। এই ভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে করোনা ভাইরাসে মৃত হাজার হাজার কফিনবন্দি লাশ দাফন হচ্ছে কালো মাটির গহ্বরে। এটি মূলত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা একটি গজব। আল্লাহ মানব জাতিকে পরীক্ষা করার জন্য এ রোগ প্রেরণ করেছেন। সমাজে যখন অন্যায় অশ্লীলতা বেড়ে যায় তখন আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য বালা মুসিবত কিংবা এমন সব রোগ দেন যা পূর্ববর্তীদের মাঝে কখনো দেখা যায় নি।
হাদীছে রাসূল(ছাঃ) বলেছেনঃ ' যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায় নি।' (ইবনে মাজাহ হা/৪০১৯) সুতরাং করোনা ভাইরাস আমাদের জন্য এখন পরীক্ষাস্বরুপ। হতে পারে এ রমাযান মাস সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাস। তাই এ পরিস্থিতিতে রমাযান মাস কীভাবে কাটানো উচিত সে সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।

১. হাদীছ থেকে পাওয়া যায় রমাযান মাসে আল্লাহ আসমানের দরজা খুলে দেন, রহমত নাযিল করেন, শয়তানকে বন্দি করেন, জান্নাতের দরজা খুলে দেন এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন। এ মাসে প্রতিদিন দুইজন ফেরেস্তা বলতে থাকেন 'হে কল্যাণের অভিযাত্রী কল্যাণের পথে অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের অভিযাত্রী থেমে যাও।' আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল(ছাঃ) বলেছেনঃ 'যে ব্যক্তি ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রমাযানের সিয়াম ব্রত পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।'(বুখারী হা/ ৩৮)
যেহেতু আল্লাহ সিয়ামের মাধ্যমে গুনাহ ক্ষমা করেন সেহেতু রমাযানে সিয়াম অবস্থায় পাপাচার ত্যাগ করতে না পারলে সিয়ামের কোনো ফায়দা হবে না। স্বয়ং রাসূল(ছাঃ) বলেছেনঃ 'যে ব্যক্তি বাজে কথা বা আমল ছাড়তে  পারল না, তার পানাহারে বিরত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।' (মিশকাত হা/ ১৯৯৯) সেজন্য আল্লাহর দরবারে পাপ বর্জন করে বেশি বেশি তওবা পাঠ করতে হবে। রাসূল(ছাঃ) প্রতিদিন ১০০ বার তওবা পাঠ করে ক্ষমা চাইতেন অথচ তিনি মা'সুম ছিলেন। সিয়াম অবস্থায় আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন। করোনা আমাদের পাপাচারের ফলস্বরূপ দু-হাতের কামাই। এখন পর্যন্ত যার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয় নি। বিধায় এর একমাত্র প্রতিষেধক স্বাস্থ বিধি মেনে চলা ও  রমাযানের অছিলায় বেশি বেশি তওবা পাঠ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। যাতে তিনি অনুগ্রহ করে আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি দেন।

২. রমাযানের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মধ্যে রয়েছে তারাবীহ, ইতিক্বাফ ও শবে ক্বদর। তারাবীহ ও শবে ক্বদরের ব্যাপারে হাদীছে এসেছে - 'যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে পূণ্যের আশায় তারাবীহ সালাত আদায় করে,  অপর হাদীছে এসেছে- শবে ক্বদরের রাত্রি জাগরন করবে তার পেছনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করা হবে।'(মুসলিম হা/ ৭৫৯, বুখারী হা/২০১৪) বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সমস্ত ইবাদত অবশ্যই বাড়িতে আদায় করতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, তারাবীহ এবং শবে ক্বদরের রাত্রি জাগরন প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জামাতে আদায় করুন। বলা বাহুল্য যে, ইতিক্বাফ জুম'আ মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত বিধায় বাড়িতে ইতিক্বাফ হবে না। অনেকেই মসজিদে যেতে নিষেধ করায় মনঃক্ষুণ্ন হচ্ছেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না যে, স্বয়ং রাসূল(ছাঃ) বৃষ্টি জনিত কারণে সাহাবীদের বাড়িতে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন।(বুখারী হা/৯০১) সেখানে করোনা ভাইরাস একটা মরণঘাতী ভাইরাস। যা থেকে দূরে থাকা বা মসজিদে না যাওয়া অবশ্যই শতভাগ জায়েজ। কেননা এটি ছোঁয়াছে রোগ। কুষ্ঠ রোগও ছোঁয়াছে যার বর্তমানে চিকিৎসা রয়েছে।অথচ রাসূল(ছাঃ) বলেছেনঃ 'কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাক।' (বুখারী হা/ ৫৭০৭) সুতরাং আমাদের ঘরে থাকতে হবে এবং ইবাদতগুলো ঘরে আদায় করতে হবে এ নির্দেশ স্বয়ং ইসলামের। কোনো রাষ্ট্র প্রধানের নয় যে জুলুম করছে বলে বিরোধিতা করতে হবে। এ মুহূর্তে ঘরে ইবাদত করাই সুন্নাহ সম্মত। যে এর বিরোধিতা করবে সে রাসূলের আদেশ অমান্য করার জন্য অবশ্যই গুনাহগার হবে।

৩. বেশি বেশি দান ও কুর'আন তেলাওয়াত করতে হবে। কমপক্ষে একবার সমস্ত কুর'আন পড়ে খতম করা উচিত। রাসূল(ছাঃ) রমযানে বেশি বেশি দান করতেন এবং জিব্রাইল ফেরেস্তাকে প্রতিদিন কুর'আন পড়ে শুনাতেন।(বুখারী হা/ ৩২২০) 

৪. যারা করোনায় আক্রান্ত তারা এ রমাযানে সিয়াম না রেখে আল্লাহ হায়াত দিলে পরে যেকোনো সময় কাযা আদায় করতে পারবেন। কিন্তু পারতপক্ষে অন্যান্য ইবাদতগুলো করতে হবে। ঠিকমত না পারলে কিংবা একেবারে অক্ষম হলেও অসুস্থ হওয়ার কারণে আল্লাহ পূর্ণ সওয়াব দিবেন। এ মর্মে বর্ণিত আছে-  'বান্দা পীড়িত হয় কিংবা সফরে থাকে, তখন তার জন্য তা-ই লেখা হয়, যা সে আবাসে সুস্থ অবস্থায় আমাল করত।'(বুখারী-২৯৯৬) আর এ অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে যদি ধৈর্য ধরে ঈমান নিয়ে মৃত্যু বরণ করে তবে শহিদ হওয়ার মর্যাদা লাভ করবে। (মুসলিম হা/ ১৯১৬)

৫. হাদীছ অনুসারে রমযানে রোযাদারকে ইফতার করালে ঐ ব্যক্তির সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়।(তিরমিযি হা/৮০৭)  অন্যান্য বছরগুলোতে মসজিদে ইফতার করানোর হিড়িক পড়ে। ইফতার করার জন্য মানুষ একে অপরের বাড়িতে, হোটেলে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। এ বছর অবশ্যই এ ধরণের জমায়েত করা থেকে বিরত থাকতে হবে, সেটা মসজিদে হোক কিংবা যে কোনো জায়গায়। বরং প্রয়োজনে প্রত্যেকে তাদের প্রতিবেশিদের মধ্যে যারা দরিদ্র ও অসহায়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের বাড়ি গিয়ে ইফতার ও সাদক্বাতুল ফিতর দিয়ে আসবেন। কোনো অবস্থাতেই করোনা আক্রান্ত বাড়িতে কিংবা এলাকায় প্রবেশ করা যাবে না এবং সেখান থেকে বের হওয়াও যাবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য অনেকেই ভয়ে ভীত হয়ে লক ডাউন ভেঙে আক্রান্ত এলাকা থেকে পালানোর চেস্টা করছেন। এটি সম্পূর্ণ শরিয়ত বিরোধী কাজ। অবশ্যই আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে - উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি সা‘দ (রাঃ)-কে বলেন-একদিন রাসূল(ছাঃ) মহামারী সম্পর্কে আলোচনার সময় বললেনঃ এ একটি শাস্তি, কতক জাতিকে এ দ্বারা শাস্তি দেয়া হয়েছে। তারপর এর কিছু অংশ বাকী রয়ে গেছে। তাই কখনো এ চলে যায় আবার কখনো তা ফিরে আসে। যখন কেউ কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনবে তখন যেন সে সেখানে না যায়। আর যে কেউ এমন এলাকায় থাকে যেখানে এর আক্রমণ ঘটেছে, তখন সে যেন সেখান থেকে পালিয়ে বের হয়ে না আসে।' (বুখারী হা/ ৬৯৭৪)

সুধী পাঠক, মহামারি আমাদের জন্য আশির্বাদ আবার অভিশাপও বটে। এ মহামারি থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই আমাদের ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে চলে বেশি বেশি সৃষ্টিকর্তার দরবারে অশ্রুপাত করে দোয়া করতে হবে। মু'মিনের জন্য এ বছরের রমাযান হয়ত ইবাদতে স্বাদহীন ও কষ্টদায়ক। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার ফায়সালায় হয়ত এ রমাযানই মহামারি থেকে মুক্তির সোপান। তাই আসুন! আমরা মহামারি সম্পর্কিত ইসলামি বিধান মেনে সিয়াম সাধনা করি এবং আল্লাহর কাছে এ আজাব থেকে পরিত্রাণ চাই। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন-আমীন!
(লেখাটি ২৪ /৪/২০২০ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সকালের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত)

আব্দুর রউফ সালাফী, মাস্টার্স(অধ্যয়নরত),রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাঃ 01723688443, ইমেইলঃ salafi12016@gmail.com 

No comments:

Post a Comment

Pages